১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধপরাধি আর পাকিস্তানে আটক ৩,৫০,০০০ জন বাঙ্গালি জিম্মি।




বহু প্রতিক্ষার পর যুদ্ধাপরাধিদের বিচার কার্য সুরু হয়েছে, চলছে অপরাধি ধড়পাকড় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দায়ের আর স্যাখ্যপ্রমান হাজির করা। অপরাধিরাও বসে নেই, তাদের দোসর, ভারাটে অধ্যাপক ও বেতনভুক্ত ব্লগার রা বিরামহিন ভাবে পত্রিকায়, ফেসবুকে – ব্লগে as well as সামু ব্লগে প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা সবই জানে তবু গোয়েবলসিও কায়দায় একই কথা বার বার বলে যাচ্ছে।
তাদের একই কথা মুজিব যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন বন্দি পাকিস্তানি সৈনিক (Pakistani military POW) দের ছেড়ে দিয়েছে, তাই এখন আর কাউকে বিচার করা চলবে না।
মামার বাড়ীর আবদার আরকি। , চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী।

এ ব্যপারটা নিয়ে অনেকেই লিখেছিল অনেক reference সহ বহুবার। কিন্তু অনেকেই মুল ঘটনাটি ঠিকমত বোঝাতে পারেননি বলে মনে হয়েছে।
 পরাজিত পাকি সৈন্যদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আটকে রাখা হয়েছিল।

১৯৫ জন বন্দি যুদ্ধাপরাধি সৈনিকদের ছেড়ে দেয়ার কারন ...

১৯৭১ এর ২৫সে মার্চ কালোরাতে ক্রেকডাউন এর পর পর দখলদার পাকিস্তানি জান্তা East Bengal regiment সহ সকল বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার হুকুম দেয়া হয়। পুর্বাঞ্চলে বেশিরভাগ বাঙ্গালি সদস্য পাক বাহিনীকে পরাস্ত করে অস্ত্র সহ আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সহ সকল বাহিনী থেকে হাজার হাজার বাঙ্গালি সদস্য দের প্রথমে নিরস্ত্র পরে চাকুরিচুত ও গৃহবন্দি করা হয়। পরবর্তিতে ডিসেম্বরের সুরুতে তাদের গ্রেফতার করে ক্যাম্পে আটক রাখা হয়। পুলিশ ও আধাসামরিক মিলিশিয়া বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদেরও গ্রেফতার করা হয়।
অনুরুপ ভাবে ডিসেম্বরের প্রথমদিকে যুদ্ধের সুরুতেই সরকারি ও বেসরকারি পদে কর্মরত বাঙ্গালি দের কে চাকুরিচুত ও নজরবন্দি করা হয়। মুক্ত চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। অনেককেই মিথ্যা পালানোর অভিযোগে গ্রেফতার বা হত্যা হয়।

১৬ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হয় এবং ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্নসমর্পন করে। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী উভয় দেশের বেসামরিক নাগরিক দের বিনা negotiation এ ছেড়ে দেওয়ার কথা, সে অনুযায়ি বাংলাদেশ অবিলম্বেই বেসামরিক নাগরিক (সামরিকদের পরিবার পরিজন সহ) ছেড়ে দেয়।
পরবর্তিতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ১৯৫ জন অফিসার-সৈনিক বাদে বাকি ৮৯ হাজার ৮ শত সৈন্য ছেড়ে দেয়া হয়।
কিন্তু বর্বর পাকিস্তানিরা তাদের ১৯৫ জন অভিযুক্ত সৈন্য ফেরত না আসা পর্যন্ত কোন বাঙ্গালিকে ছাড়া হবেনা বলে হুংকার দেয়।
কিন্তু আবার এদিকে পশ্চীম ফ্রন্ট এ আটক ভারতীয় সৈন্য এবং বিধ্বস্ত বিমান পাইলট সহ সকল ভারতীয় দের দ্রুতই ছেড়ে দেওয়া হয়।
পাকিস্তানে চাকুরিরত বাংগালী ২০ হাজার সেনাসদস্য, নৌ ও বিমান বাহিনী, আধাসামরিক রেঞ্জার্স শিমান্তরক্ষী এবং পুলিশ সদস্য। এছাড়া সরকারি-আধাসরকারি সংস্থায় চাকুরিরিত ১৫-২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারি, ছাত্র। দোকান, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অগনিত বাঙ্গালি সহ মোট তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বাঙ্গালি পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছিল। এদের অনেকেই দির্ঘদিন স্থায়ীভাবে বসবাস করছিল।

এই চার লাখ হতভাগ্য বাঙ্গালিদের ৭১ সাল থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে প্রায় তিন বছর যাবত যুদ্ধবন্দির মত জিম্মি করে রাখা হয়েছিল এই ১৯৫ জন পাকি যুদ্ধাপরাধির বিপরিতে।

UNHR, Red cross. সহ অনেকের চেষ্টা সত্তেও চার লাখ আটক বাঙ্গালি দের ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হয় নাই। পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এত বিশালসঙ্খক বেসামরিক নাগরিক দের এতো দির্ঘ সময় আটকে রাখার কোন উদাহারন দেখা যায় না। আটক চার লাখ বাঙ্গালির প্রায় সবাই মুসলমান হলেও আরব মুসলিমজাহান ও সাম্রাজ্যবাদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট এই ব্যপারে পাকিস্তান কে সমর্থন দেয়।
ইতিমদ্ধে আটক নাগরিক দের অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হতে থাকে। তাদের পলায়ন ঠেকাতে শিবিরে-জেলে স্থানান্তর সুরু করে পাকিস্তানিরা। পলাতক বাঙ্গালি ধরতে হাজার রুপি পর্যন্ত পুরষ্কার ঘোষনা করা হয়েছিল।
এদিকে ১৯৭৩ রের পর OIC সম্মেলনের পুর্বে বংগবন্ধু বিভিন্ন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে তীব্র চাপের সম্মুখিন হয়। বাংলাদেশকে ইসলামি দেশগুলোর সংস্থা OIC সদস্যভুক্ত করা হয়। আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, সৌদি রাজা ফয়সাল এবং জর্ডানের কিং হোসেন এর উদ্যোগে সাতটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধি ঢাকা সফর করেন। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য বংগবন্ধুকে রাজী করাতে। মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন .. কিন্তু তাদের চাপ অব্যাহত ছিল।

এমতাবস্থায় দির্ঘদিন আটক বিপুলসংখক পনবন্দি বাঙ্গালিদের অসহায় অবস্থা বিবেচনা করে নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ ১৯৫ জন যুদ্ধপরাধি বিচার করা থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। যদিও যুদ্ধাপরাধ আইন ১৯৭৩ তৈরি করা ও ট্রাইবুনাল প্রস্তুতি নিয়ে বিচার শুরুর প্রকৃয়া চলছিল।

১৯৭৩ এর শেষ দিকে ও ১৯৭৪ এর প্রথম দিকে সিমলা তৃ-দেশীয় চুক্তির খসড়া তৈরি হয়। এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১৯৫ জন সামরিক যুদ্ধপরাধি বন্দিদের সর্ত সাপেক্ষে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়।
তবে পাকিস্তানি পক্ষকে কয়েকটা শর্ত চুক্তিপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করে। যার একটি ছিল -
"এই ১৯৫ জন অপরাধি কে ছাড়া হবেনা। যুদ্ধপরাধের বিচার পাকিস্তানেই করা হবে"
কিন্তু পরে পাকিস্তান তা করেনি।

জিম্মি বাঙ্গালিদের ছেড়ে দেয়া সুরু হয় ১৯৭৪ এর দিকে। কিছু হাই অফিসিয়াল চামচাদের কিছু আগেই ছেড়ে দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিক রেডক্রস এবং UNHCR এর ভাড়াকরা কয়েকটি বিমান পালাক্রমে এদের নিয়ে আসে, বেশকিছু বাঙ্গালি রাশিয়ান জাহাজেও আনা হয়
 দেশে ফিরে আসার সময় তাদের সম্পুর্ন খালিহাতে আসতে হয়।
এমন কি তাদের কোন টাকা পয়সাও আনতে দেয়া হয়নি। অনেকের গহনাগাটি কেড়ে রাখা হয়েছিল। বকেয়া বেতন এবং ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সঞ্চয়পত্র, ইন্সুরেন্স পলিসি, ঘর-বাড়ী, দোকান, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আগেই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।

রেফারেন্স
দৈনিক বাংলা ১৯৭২-১৯৭৪
সাপ্তাহিক বিচিত্রা
Guardian 1972-1974
International Herald Tribune (Hong kong)
New York Times
Time (Asian edition)
Newsweek