আলুভাঁজা বা ফ্রেঞ্চফ্রাই এর গল্প......!

গ্রাম থেকে এসে সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে কতিপয় দুষ্টু আর বাঁদর প্রকৃতির বালক-বালিকার দল! হ্যাঁ বালক-বালিকাই, তরুন বা তরুণী তখনো হয়ে ওঠেনি ওরা কেউই! অন্তত মনের দিক থেকে তো নয়ই।

এদের মধ্যে তিন জন খুব বন্ধু হয়ে গেল, খুব বেশী-ই বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই...... একজন বালিকা আর দুইজন বালক। পশ্চিমপাড়া (মেয়েদের হল গুলির অবস্থান) তখনো অচেনা, তুত বাগানের নাম তখনো শুনেনি, সিলসিলা? সে অনেক দূরের পথ!
দৌড় ওই ইবলিশ চত্বর আর সাবাস বাংলাদেশ পর্যন্ত, হাটাহাটি শুধু মাত্র প্যারিস রোড ধরেই, লাইব্রেরীতে যাওয়া শুধুই ভাব মারার জন্য! যেখানেই যাক, ওই তিন জনই! একই সাথে, ক্লাসে বসে তিন জন একই বেঞ্চে, যে যাই বলুক আর ফিসফিস করুক, তিন জনের কেউই কানে তোলেনা, কিছুই!

এদের মধ্যে একজন নিদারুণ দরিদ্র! একজন ভীষণ হিসেবি, এ ছাড়া তার উপায়ও ছিলনা, আর একজন সব কিছুতেই উদার! ভীষণ রকমের উদার! উলেখ্য, দরিদ্র আর হিসেবি দুইজন, অবধারিত ভাবেই দুই বালক! আর সবচেয়ে উদার বাকিজন মানে সেই বালিকা! তারা একত্রে চলতে চলতে বালিকা আর বালক থেকে বিভাগের দুষ্টু, ফাঁকিবাজ (হিসেবি জন ছাড়া) আর ছন্ন ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীর মর্যাদায় ভূষিত হইলো, অতি অল্প সময়েই!

প্রিতিদিন সময় মত ক্লাসে আসা, এক বা আধ খানা ক্লাস করা, বাকি সময় হুল্লোড়ে কাটানো, ধীরে-ধীরে পশ্চিম পাড়ার সাথে পরিচিত হওয়া! বিশেষ করে রোকেয়া হলের রুম নাম্বার ৪১০! সেই বান্ধবীর সাময়িক বাসস্থান। সময় অসময় এটা সেটা খাওয়া! কিন্তু বিল দেবার সময় দুই বন্ধুর কেউই নেই! শুধুই তাঁদের বান্ধবী! সব সময়, এক-একজন, অন্য আর এক-একজনের প্রেমে না পড়ে আলাদা হবার আগ পর্যন্ত! সে গল্প অন্য দিনে, ভিন্ন আমেজে...

সকালে নাস্তা, ক্লাসের ফাঁকে চা বিস্কিট, বিকেলে ভাজি-ভুজি আর সন্ধার আগের কুলফি! প্রতিদিন, বিল সেই একজনেরই! যেদিন ক্লাস থাকতো না, অথচ বিকেলে হালকা খিদে-খিদে ভাব, দুই বন্ধু মিলে পরামর্শ চল, রোকেয়া হলে যাই!

কারণ, ওরা জানে, ওরা ডাকলেই আমাদের বান্ধবী হাজির, তার টাকার থলে নিয়ে! এরপর এটা সেটা খেয়ে, বান্ধবীর কাঁধে নিশ্চিন্তে আর নির্ভাবনায়, একটুকুও দ্বিধাহীন ভাবে বিল চাপিয়ে দিয়ে, সন্ধার পরে, টুক টুক করে মেসে ফেরা!

তো দুই বন্ধুর এই সব নিঃসঙ্গতা, সামান্ন ভণ্ডামি আর হালকা কৃপণতা দেখে তাঁদের বান্ধবী নিজ থেকেই উৎসাহের সাথে ঘোষণা দিল যে, এখন থেকে যখন, যেখানে, যা-ই খাইনা কেন সব সময়, সব বিল সে দেবে! ওয়াও গ্রেট...!

সেইদিন, সেই খুশিতে দুই বন্ধু প্যারিস রোডের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আর সেই সময়ের বেশ জনপ্রিয় গান “আমার ভাঙা ঘরে, ভাঙা চালা, ভাঙা বেড়ার ফাঁকে, অবাক জ্যোৎস্না ঢুইকা পরে, হাত বাড়াইয়া ডাকে” একেবারেই সেই দুই বন্ধুর প্রতিদিনের অবস্থার মত করে (খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারটায়) তাঁদের বান্ধবীর চাঁদের জ্যোৎস্না হয়ে আগমন! এবং সেই গান তাদের কণ্ঠে এতটাই মাধুর্য আর আবেগ ছাড়িয়েছিল যে গান শেষ হবার সাথে, সাথে চার দিকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবার একই সাথে হাততালি পেয়ে বাহবা কুড়িয়েছিল! সেও এক বিশাল প্রাপ্তি, সেই সময়ের!

সেই থেকে ক্লাসের ফাঁকে মামার দোকানের চা-বিস্কুট আর লাড্ডু, মেসে ফিরে দুপুরের খাবারের আগে টুকিটাকির প্যাঁটিস আর আইসক্রিম! ভর সন্ধ্যায় কাজলা গিয়ে দই আর মিষ্টি! ছুটির দিন গুলোর বিকেলে সিলসিলার ভাজিভুজি আর কোক! দুই বন্ধু চরম নিশ্চিন্ত! যখনই কিছু খাবার ইচ্ছে হয়, তখনই রোকেয়া হল, রুম নাম্বার ৪১০!

কিন্তু দুই বন্ধুরও তো কিছু দায়িত্ব আছে! ওদের না হয় উপায় নাই কিন্তু ইচ্ছা তো আছে শোল আনাই! তাই একদা, যখন শুনিল, যে আজ বান্ধবীর রান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা, তাই না খেয়েই থাকবে! দুই বন্ধুর কিঞ্চিৎ মন খারাপ হল! আরে, তারা সব সময় এতো কিছু খায় ওর কাছ থেকে, আর ও আজ রান্না করতে ইচ্ছে করছেনা বলে না খেয়ে থাকবে? সে কি করে হয়? তবে কেমন বন্ধু, কিসের বন্ধুত্ত? তো ঠিক আছে আজ হোক সত্যিকারের বন্ধুত্তর প্রমান!

দুই বন্ধু মিলে মেসের কাছের-ই এক হল থেকে ফোন দিল রোকেয়া হলের রুম নাম্বার ৪১০ এ! বান্ধবী কল পেয়ে নিচে এলো, আর তাকে জানিয়ে দেয়া হল, তুই চিন্তা করিস না, আমরা খাবার নিয়ে গেটে আসতেছি! বান্ধবী তো অবাক! কিভাবে খাবার নিয়ে আসবে? কোত্থেকে?

এইবার দুই বন্ধু মিলে দুই জনের মেসের খাবার ভাগ তিন ভাগ করে নিল, একটি বাটিতে করে ভাত-ভাজি-আর মাছ দিয়ে আলাদা করে নিয়ে গেল বান্ধবীর জন্য! এই দেখে বান্ধবী আবেগে প্রায় কেঁদেই ফেলল! আর খুবই খুশিতে ঘোষণা দিল যে আগামীকাল সবাই মিলে নতুন একটা খাবার খাওয়া হবে!

তো কিসেই খাবার? হ্যাঁ তারা তিনজন আগামীকাল সাহেব বাজারে গিয়ে ফ্রেঞ্চফ্রাই খাবে! সবাই যে যার মত চলে গেল।

কিন্তু মেসে ফিরে দুই বন্ধুর তো আর ঘুম ধরেনা চোখে, কেন? কারণ চোখে ফ্রেঞ্চফ্রাই এর স্বপ্ন! সেটা কি জিনিস! কি দিয়ে বানায়? কিভাবে খায়? এই চিন্তা, সেই চিন্তা, আরও অনেক আজব চিন্তা! যাই হোক রাতের শেষে সকাল, ক্লাস, দুপুরে মেসে ফিরে নাকে-মুখে দুটো দিয়েই ছুট পশ্চিম পাড়ার দিকে, বান্ধবীকে কল দিতে হবে! শহরে যাব ফ্রেঞ্চফ্রাই খাবে!
My Facebook Page
অতপর তিন জন একসাথে হয়ে, একটি রিক্সা নিয়ে শহরের পানে ছুটল, তাঁদের বান্ধবী তো ফ্রেঞ্চফ্রাই নিয়ে দুই বন্ধুর আজব চিন্তা ভাবনা জানেনা, গল্পে-গল্পে এক সময় পৌঁছে গেল রাজশাহী শহরের জিরো পয়েন্টে, ঢুকে গেল একটি ফাস্ট ফুডের দোকানে (চিলিস অথবা গুডিস) কয়েকটা খাবারের অর্ডার দেয়া হল যার ভিতরে সেই কাঙ্ক্ষিত বা নিজস্ব কল্পনা ও ভাবনার মিশেলের ফ্রেঞ্চফ্রাইও রয়েছে!

খাবার এলো, তিনজন মিলে খাচ্ছে, এটা-ওটা-সেটা! বেশ কিছুক্ষণ খাবার পরে ও দুই বন্ধুর কিছু ফিসফিসানি... একজন আর একজনকে

জিজ্ঞাসা, “দোস্ত বলল যে ফ্রেঞ্চফ্রাই খাওয়াবে? তা কই?”

অন্য জন, “তুই জিজ্ঞাসা কর দোস্ত?” “আরে না তুই কর?”

পরে, অবশেষে লাজ-লজ্জা আর শরমের মাথা খেয়ে বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা, “কিরে অনেক কিছুই তো খেলাম, কিন্তু ফ্রেঞ্চফ্রাই কই?” বান্ধবীর তো মাথায় হাত! লাজে টকটকে লাল হয়ে গেল মুখ-নাক-কান!

অবশেষে দুই বন্ধুর দুই হাতে ধরে থাকা চিকন চিকন আলু ভাজার স্লাইস দেখিয়ে বলছে...

“ওটাই ফ্রেঞ্চফ্রাই...!!”

সেই হাতের আলু ভাজার দিকে তাকিয়ে, আর দুই বন্ধু দুই জনের দিকে বিরস বদনে চোখে চোখ রেখে এতটাই ব্যাথিত হয়েছিল যে... দুইজন একই সাথে বলে উঠলো, হ্যাঁ একই সাথে......

“এতো আলু ভাঁজারে, এটা কিভাবে ফ্রেঞ্চফ্রাই হইলো...!!!”

দুই জনের সকল আনন্দ আর আবেগ বেদনা আর ব্যাথায় রূপ নিল!

সেই থেকে দুই বন্ধু পারোতো পক্ষে ওই আলুভাঁজা (অন্যদের কাছে ফ্রেঞ্চফ্রাই) এড়িয়ে চলে! আর দৈবাৎ কখনো কোন বন্ধু মহলে খেতে গেলেও ওটাকে আলুভাজা বলেই সম্বোধন করে, তাতে যে যাই মনে করুক! ওতে ওই দুই বন্ধুর কিছুই আসে-যায় না!

তাই ওটা ওদের কাছে আলুভাজা-ই, ফ্রেঞ্চফ্রাই কখনোই নয়......!